মো. আতিকুর রহমান
চার মাসে ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ৬ রোগীর পিছনে ৮ লক্ষ টাকা ব্যয় নিয়ে খোদ হাসপাতালের সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। গণমাধ্যমে এ দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ পাওয়ায় সর্বমহলে নিন্দার উঠেছে। এমনিতেই চিকিৎসা সেবার মান, রোগীর সাথে চিকিৎসকদের অসম্মান জনক আচরণ, খামখেয়ালি করে ইসিজি-আল্ট্রাসনোগ্রাম-এক্সরে মেশিন অচল করে রাখা, সরকারী ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে ব্লাকে বিক্রি করাসহ নানান দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আত্মসাত করছে লাখ লাখ টাকা। তার মধ্যে গত মার্চ মাস থেকে জুন পর্যন্ত ৪ মাসে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৬ জন করোনা রোগিকে চিকিৎসা খরচ বাবদ ৮ লাখ টাকা ব্যয়ের ঘটনায় জেলাজুড়ে আলোচনা সমালোচনা চলছে। সীমাহীন দুর্নীতিতে ডুবে রয়েছে সদর হাসপাতাল তথা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। গণমাধ্যমে এ দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ পেলে নিন্দার ঝড় ওঠে সর্বমহলে।
জানাগেছে, ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কোভিড-১৯ এর মাত্র ৬ জন রোগীর চিকিৎসায় খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। মার্চ ২০২০ থেকে জুন পর্যন্ত এ খরচ দেখানো হয়। আনুসাঙ্গিক খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩ লাখ টাকা। হাসপাতালের সাবেক সিভিল সার্জন শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার থাকাকালীন প্রধান সহকারি আব্দুল মতিন এসব খরচের বিল ভাউচার তৈরী করে অর্থ উত্তোলন করেছেন। চলতি অর্থ বছরে (২০২০-২১) আরো ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানাগেছে।
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে মার্চ এপ্রিল মাসে করোনার শুরুতে পজেটিভ আক্রান্তদের চিকিৎসা না দিয়ে বরিশালে রেফার্ড করা হয়েছে। এ নিয়ে রোগীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানালেও সিভিল সার্জন কোন উদ্যোগ নেননি। সিভিল সার্জন শ্যামল কৃষ্ণ বলতেন, ‘‘আমাদের আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। অনেকেই বাসায় কোয়ারেন্টাইনে থাকতে চায়। তাই তাদের ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়না।” কিন্তু যখন জুন মাসে করোনার বরাদ্দ টাকা ফেরৎ পাঠানের নির্দেশনা আসে তখনই লুটপাটের প্রক্রিয়া শুরু করতে ওয়ার্ডটি চালুর ঘোষণা দেয়া হয়। তাই মে-জুন মাসে পজেটিভ রোগী ভর্তি করে বরাদ্দের ৮ লাখ টাকা ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা খরচ বাবদ গত অর্থ বছরে বরাদ্দ পাওয়া গেছে ২০ লাখ টাকা। এ বছরের (চলতি বছর) মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বরাদ্দ হতে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৮ লাখ টাকা। অবশিষ্ট টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খরচকৃত টাকার মধ্যে উল্লেখিত সময়ে কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় চিকিৎসকসহ ২১ জনের খাবার খরচ একটি মোটা অংকের টাকা দেখানো হয়েছে। ঐ সময় কর্মরত নার্সদের অভিযোগ তাদের জন্য খাবার বিলের বাবদ কোন বরাদ্দ দেয়া হয়নি। দেয়া হয়নি তাঁদের কোন খবারও।
এ বিষয়ে নার্স শাহারুন্নেসা, রেখা রানী, শিপ্রা মালোসহ ৬ জন জানান, প্রধান সহকারি মতিন আমাদের জনপ্রতি ২ হাজার টাকা এবং রিনা মিস্ত্রি, তাছলিমাসহ আরো ৬ জনকে ৪ হাজার টাকা করে দেয়। এ টাকা কিসের জানতে চাইলে কোন স্বাক্ষর ছাড়াই মতিন আমাদের টাকা দিয়ে বলেন, করোনা ডিউটির জন্য মানবিক কারণে এটা দেয়া হয়েছে।
সূত্রমতে মে-জুন দুই মাসে চিকিৎসকদের ঝালকাঠি বরিশাল পরিবহন খরচ বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ভূয়া ভাউচারের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে। যদিও হাসপাতালের সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসকদের আনা নেয়া করা হয়েছে। গত অর্থবছরে করোনাকালীন যাতায়াত বাবদ কত টাকা বিল পেয়েছেন জানতে চাইলে চিকিৎসক আবুয়াল হাসান বলেন, মনে নেই। কিভাবে বরিশাল থেকে আসা যাওয়া করেছেন প্রশ্নের জবাবে বলেন প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে। অথচ ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের এ্যাম্বুলেন্স চালক আনোয়ার হোসেন ও মহসীন জানান, বরিশালে থাকা ঝালকাঠির কর্মরত চিকিৎসকদের সরকারি এ্যাম্বুলেন্সে আনা নেয়া করেছি আমরা, কিন্তু এজন্য বেতনের বাইরে কোন পারিশ্রমিক পাইনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখিত খাত ছাড়াও ৬জন রোগীর চিকিৎসাকালিন সময়ে বিল ভাউচারের মাধ্যমে শুধু আনুসাঙ্গিক খাতেই খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৩ লাখ টাকা। জীবাণুনাশক বিল উত্তোলন করা হয়েছে ৩৬ হাজার টাকা। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন খাতে ৬৬ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারি আব্দুল মতিন জানান, গত অর্থ বছরের ২০ লাখের ৮ লাখ টাকা সঠিক ভাবেই খরচ হয়েছে। বাকি টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। খরচের খাতে কোন অনিয়ম বা ত্রুটি নেই। খাবার খরচ নিয়ে নার্সদের অভিযোগ সঠিক নয়। চিকিৎসকদের ভাড়া গাড়িতে বরিশাল-ঝালকাঠি আসা যাওয়ার ভাউচার দাখিলের মাধ্যমে খরচের টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. শ্যামল কৃষ্ণ হাওলাদার বলেন, আমি প্রধান সহকারির সাথে কথা না বলে এই খরচ করা বরাদ্দের বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। তার সাথে যোগাযোগ করে যা জানার জানতে পারেন।
এ বিষয়ে ঝালকাঠির নবাগত সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী বলেন, আমাকে বলা হয়েছে গত অর্থ বছরে ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছিল। এরমধ্যে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তার মধ্যে ৩ লাখ টাকার নাকি মাস্ক ও জীবাণুনাশক ইত্যাদি কেনা হয়েছে। বাকি ৪ লাখ টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়েছে।
এদিকে হাসপাতালে এ দুর্নীতির যারা বিরোধিতা করছে দুর্নীতি পরায়নচক্রটি তাদেরকে ভয়ভিতি হূমকি দিচ্ছে এবং ষড়যন্ত্র করে এদের দমানোর মিশনে নেমেছে। চক্রটি তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে বলে জানাগেছে।